উচ্চ রক্তচাপ একটি জটিল সমস্যা। এটি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে হৃদপিণ্ড, যকৃত, চোখ ও কিডনি ঝুঁকিতে থাকে হাই প্রেশারে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। নিজের অজান্তেই অনেকে উচ্চ রক্তচাপ বয়ে বেড়ান। আবার উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ার পরও অনেকে অবহেলা করেন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের নিয়মকানুন মানা হয় না। খাবারে পরিমিত লবণের ব্যবহারের কথা ভুলে যান, অধিক তেল-চর্বিসমৃদ্ধ খাবার, ভাজাপোড়া খাবার, ট্রান্সফ্যাট সমৃদ্ধ বেকারি, ফাস্ট ফুড খাওয়া বা কোমল পানীয় পান চালিয়ে যান।
শরীরের ওজন ঠিক রাখা, ধূমপান বা মদ্যপান বর্জন করা, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের অভ্যাসও অনেকের গড়ে ওঠে না। মানসিক চাপ, স্ট্রেস বা উদ্বিগ্নতায় ভোগা মানুষও কম নয়। অধিকাংশ মানুষেরই ডাক্তারের কাছে না গেলে রক্তচাপ মাপা হয় না। অনেকে আবার কোনো একসময় রক্তচাপের ওষুধ শুরু করেছেন সেটাই চলিয়ে যান। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কী নেই, তা জানে না।
উচ্চ রক্তচাপ অনেক সময় বংশগত কারণেও হয়ে থাকে। আবার বদঅভ্যাসের কারণেও হয়ে থাকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।
অধিকাংশ সময় রক্তচাপটা স্বাভাবিক মাত্রার ভেতরই থাকে। সাধারণত বয়স যত কম, রক্তচাপও তত কম হয়। যদি কারো রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালীনও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে, তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী।
উচ্চ রক্তচাপ কি কোনো জটিল ব্যাধি
উচ্চ রক্তচাপ ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাÍক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কী কী জটিলতা হতে পারে
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৃৎপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ।
কী কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়
৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে। কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, যা নিম্নরূপ-
বংশানুক্রমিক
উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশংকা থাকে।
ধূমপান :
ধূমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানারকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনি, শিরার নানারকম রোগ ও হৃদরাগ দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ :
খাওয়ার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়।
অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা :
যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে।এতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং এর ফলে অধিক ওজনসম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস :
অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন- মাংস, মাখন ও ডুবোতেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়বে। ডিমের হলুদ অংশ এবং কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কলেস্টেরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কলেস্টেরল হলে রক্তনালির দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
অতিরিক্ত মদ পান :
যারা নিয়মিত অত্যধিক পরিমাণে মদপান করে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়।
ডায়াবেটিস :
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।
অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা :
অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। কিছু কিছু রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এ কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল-
কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনির বংশগত রোগ, গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি-অ্যাকলাম্পসিয়া হলে, অনেক দিন ধরে
জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েডজাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথানাশক কিছু কিছু ওষুধ খেলে।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কী করা উচিত
জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে :
খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছলে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো।
খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা :
কম চর্বি ও কম কলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন- খাসি বা গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা, ডিম কম খেতে হবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো।
লবণ নিয়ন্ত্রণ :
তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
মদপান :
মদপান পরিহার করতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম :
সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি।
ধূমপান বর্জন :
ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ :
যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে :
নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে।
রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা :
নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কী চিকিৎসা করাতেই হবে
উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে। কোনোক্রমেই চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন।
কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না। এ ধারণাটাও সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের রোগীরাই হঠাৎ হৃদরাগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।